শাঁখারিবাজারের শাঁখাশিল্প
ফারজানা ওয়াহিদ
পুরান ঢাকার প্রায় চারশ’ বছরের ঐতিহ্য শাঁখারিবাজারের শাঁখাশিল্প। যুগ যুগ ধরেই এই ঐতিহ্য লালন করে আসছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ঢাকার অনেক ঐতিহ্য স্থান হলেও এখনো সগর্বে টিকে আছে শাঁখারিবাজারের শাঁখাশিল্প। মন্দিরের ঘণ্টা বাজছে, বাজছে শঙ্খ আর উলুধ্বনি। শারদ শুভ্রতা নিয়ে এসেছে বিপদনাশিনী দেবী দুর্গা। তাই হাতে সময় নেই একদমই। দেবীকে সাজানোর পাশাপাশি পূজার অনুষঙ্গ কিনতে ব্যস্ত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সনাতন ধর্মের ঐতিহ্য শাঁখা-সিঁদুর। মূলত স্বামীর মঙ্গলের জন্যই হাজার বছর ধরে এই শাঁখা-সিঁদুর ব্যবহার করছেন হিন্দু নারীরা। সারা বছর চাহিদা থাকলেও পূজা এলে তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কারণ বিদায়বেলায় দেবি দুর্গাকেও যে পরিয়ে দিতে হবে শাঁখা-সিঁদুর। তাই শাঁখারিবাজারের শাঁখা-সিঁদুরের দোকানগুলো এখন ক্রেতা পদরচারণায় মুখর। নতুন ডিজাইনের শাঁখাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন ক্রেতারা। মূলত শঙ্খ থেকেই তৈরি হয় এই শাঁখা যা আমদানি করা হয় শ্রীলঙ্কা থেকে। শঙ্খ কেটে নিপুণ হাতে নানা ডিজাইনের শাঁখা তৈরি করেন কারিগররা। এক একটি শঙ্খ থেকে তৈরি হয় ৩ থেকে ৪ জোড়া শাঁখা। মান আর ডিজাইন অনুযায়ী শাঁখার দামে থাকে ভিন্নতা।
ঢাকায় সে সময় ৮৩৫ জন শাঁখারি বসবাস করতেন। ধারণা করা হয়, দেড় হাজার বছর আগে বল্লাল সেনের শাসনামলে শাঁখারি বাজারের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে। এই শাঁখা শিল্পটাও দক্ষিণ ভারতেই উৎপত্তি। শাঁখারিরা বাংলাদেশে প্রথমে বসতি গড়ে তোলেন ঢাকার বিক্রমপুরে। পরে সেখান থেকে ঢাকার বর্তমান শাঁখারি পট্টি অর্থাৎ শাঁখারি বাজারে তাদের বসতি গড়েন। এরপর থেকে প্রয়োজনের তাগিদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাঁখারিদের বিস্তৃতি ঘটে। বর্তমানে বরিশাল, শরীয়তপুর, রূপসা, সাতক্ষীরা, খুলনা, পাবনা, নাটোরের জামনগর, টাঙ্গাইলের অলোয়া, মুন্সীগঞ্জের বকজুড়ি, ফরিদপুরের মধুখালিতে শাঁখারি সম্প্রদায় দেখা যায়। সপ্তদশ শতকের মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথানের লেখায় শাঁখারিবাজারের উল্লেখ রয়েছে। তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী শাঁখারি বাজার গুঁড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর শাঁখারিরা আবার এসে বসবাস শুরু করেন এই শাঁখারি বাজারে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হিন্দু বসবাস করেন শাঁখারি বাজারে। শাঁখারি বাজারের বর্তমান শাঁখারিরা জানান, তারা শুধু পূর্বপুরুষদের মধ্যে ত্রৈলক্যনাথ ধর এবং সাগর সুরের মতো প্রথিতযশা শাঁখা শিল্পী এবং ব্যবসায়ীর কথা স্মৃতিতে আনতে পারেন।
সমুদ্রের বিশেষ কয়েক প্রজাতির শঙ্খ, যা শ্রীলঙ্কার জাফনা ও ভারতের চেন্নাইয়ের তিতপুরে পাওয়া যায়। শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য যেসব প্রজাতির শঙ্খ বা শামুক ব্যবহৃত হয় সেগুলো তিতপুঁটি, রামেশ্বরি, ঝাঁজি, দোয়ানি, মতিছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটি, এলপাকারপাটি, নায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, তিতকৌড়ি, জাহাজি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপটি ও আলাবিলা। এগুলোর মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সর্বোৎকৃষ্ট। এরপরেই জাডকি ও পাটি শঙ্খের স্থান। আর আলাবিলা শঙ্খ হচ্ছে সবচেয়ে নিম্নমানের। ১৯১০ সালে ১৫০টি তিতকৌড়ি শঙ্খের মূল্য ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ১৯৯৯ সালে যার মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় চৌদ্দ হাজার থেকে ত্রিশ হাজার টাকায় আর বর্তমানে তা দাঁড়ায় মহামূল্যে।
বিভিন্ন মাপের শঙ্খবলয় তৈরি করতে শিল্পীরা ২.৫ থেকে ৪ ইঞ্চি ব্যাসের শঙ্খ ব্যবহার করেন। শঙ্খের অলঙ্কার তৈরিতে আর যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয় তা করাত, তেপায়া টুল, হাতুড়ি, নরুণ।
কথিত আছে, সমুদ্রতলে পঞ্চজন নামক এক অসুরকে বধ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তখন মৃত্যুপথযাত্রী অসুরের অনুরোধে মৃত্যুর চিহ্ন হিসেবে হাড় দিয়ে শঙ্খ বানিয়ে শ্রীকৃষ্ণ তার হাতে পরিয়ে দেন। মৃত্যুর পূর্বে পঞ্চজন অসুরের আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে সনাতন বিবাহিত নারীদের শাঁখা পরার নির্দেশ দেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সেই থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বিবাহিত নারীরা কৃষ্ণের আদেশ পালন করতে শাঁখা ব্যবহার শুরু করেন। একই সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ অসুরশক্তিকে দূরে রাখতে প্রতি গৃহে সূর্যাস্তের সময় শঙ্খধ্বনি দিতেও বলেন নারীদের। অবশ্য আদি সভ্যযুগের শুরুর দিকে মানুষ শঙ্খের বাসন-কোসন ব্যবহার শুরু করে এমন নিদর্শন আছে ইতিহাসে। শঙ্খের উচ্চধ্বনি দিয়ে লোকসমাগম করা হতো বলে প্রচলিত।
শঙ্খের পাশাপাশি শঙ্খের গুড়াও অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। এই শঙ্খের গুড়া দিয়ে তিলক তৈরি করা হয়। যা আশীর্বাদ হিসেবে কপালে পড়ান হয়। অনেকে এটা দিয়ে সিঁদুর তৈরি করেন। আবার এই গুঁড়া রূপচর্চার কাজেও ব্যবহার করা হয়।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই শিল্পেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। শাঁখা কাটতে এবং অন্যান্য কাজে আধুনিক মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। বিগত ১৫ বছর ধরেই মেশিনের ব্যবহার হচ্ছে। তবে এই শিল্পের আরও আধুনিকায়ন দাবি করেন শাঁখারিরা। শাঁখায় এখন সোনা ব্যবহার করা হচ্ছে। সোনার ডিজাইন শাঁখায় তুলে ধরা হচ্ছে।
শাঁখারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, লক্ষ্মী শঙ্খ ভাণ্ডার, শঙ্খ ভাণ্ডার, বিধান শঙ্খ ভাণ্ডার, মা-পদ্মা শঙ্খ ভাণ্ডার, জয়গুরু শঙ্খ ভাণ্ডার, লক্ষ্মীনারায়ণ শঙ্খ ভাণ্ডার, প্রিয়াংকা শঙ্খ ভাণ্ডার, মা মনসা শঙ্খ শিল্পালয়, ধর অ্যান্ড সন্স, শঙ্খ মন্দিরসহ ২০-২৫টি শঙ্খের দোকান আছে।
শাঁখারি বাজারের বর্তমান অবস্থা বলতে গেলে, তারা শুধু তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে ত্রৈলক্যনাথ ধর, সাগর সুরের মতো প্রথিতযশা শাঁখা শিল্পী এবং ব্যবসায়ীর কথা স্মৃতিতে মনে করতে পারেন। তারা সাতচল্লিশের দেশ ভাগের আগে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ভারতের বাগ বাজারে এখনও ত্রৈলক্যনাথের বংশধররা এই ব্যবসা ধরে রেখেছে। এখনও এই শিল্পটি ধরে রেখে এই শাঁখারী বাজারেই বসবাস করছে প্রায় ১৫০টি পরিবারে প্রায় ১০হাজার লোক। কিন্তু শাঁখারীদের বর্তমান প্রজন্ম আর এই কাজে আসতে চান না। তারা এখন পড়াশোনা, অন্য পেশা এবং অন্যান্য ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েছে। শাঁখারীদের অনেকই এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন পেশায় লিপ্ত। বলতে গেলে তারা প্রায় আগ্রহই হারিয়ে ফেলছে এই শিল্পে। কাঁচামালের অভাব, আমদানীকারকের অভাববোধই তাদেরকে এ শিল্প থেকে সরে আসতে বাধ্য করছে।
শাঁখারিরা বলেন ‘আমাদের সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নাই। কারণ শাঁখার কাঁচামাল আমাদের দেশে আসে শ্রীলঙ্কা থেকে। এই কাঁচামালের আমদানির ওপর সরকার ৪০ শতাংশ কর ধার্য করে। যেখানে ভারতে এর হার ৫ শতাংশ।’ তারা আক্ষেপ করে বলেন, ‘এটি একটি ধর্মীয় উপকরণ (হিন্দু সম্প্রদায়ের সধবা মহিলাদের হাতের চুড়ি)। তবুও সরকার এর ওপর কর কমায় না।’
শাঁখারীদের আবাসনের অনেক পরিবর্তন এসেছে। জায়গা ছোট কিন্তু তারা সুন্দর মতো থাকে। আগের থেকে এখন অনেক ঝুঁকি কমে গেছে।’ শাঁখারী বাজারকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ ঘোষণার প্রস্তাবের বিষয়ে শাঁখারিরা বলেন, ‘ঢাকা শহরে অনেক অনেক জমিদার বাড়ি আছে যে গুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলোকে সরকার ধরে রাখেনি। যা উচিৎ ছিল। আর এখন, সরকার কারও কারও কুপরামর্শে আমাদের পৈত্রিক আবাস থেকে উচ্ছেদ করতে চায়।’
নব্বইয়ের দশকে শাঁখারি বাজারে শাঁখারির সংখ্যা ছিল আটশ’র ওপরে। কিন্তু বর্তমানে শঙ্খের ব্যবহার কমে যাওয়ায় শাঁখা তৈরি ও বিপণন মিলে শ’খানেক লোক আছে এ পেশায়। এখানকার শাঁখারিদের নিপুণ হাতে তৈরি নকশার শাঁখা এক সময় বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ছিল।কিন্তু বর্তমানে ভারতের মেশিনের তৈরি শাঁখা ঢাকার বাজারে আমদানি হচ্ছে। এর ফলে হাতের তৈরি শাঁখার বাজার নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রাচীন এ শিল্পকে রক্ষার জন্য সরকারের দৃষ্টি দেয়া উচিত। তা না হলে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প।
এক সময় বেশ রমরমা থাকলেও বর্তমানে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন ঐতিহ্য ধরে রাখতেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন শাঁখারিদের উত্তরসূরিরা। তবে ব্যবসার পরিসর ছোট। কিন্তু তারপরও শাঁখার কদর কমেনি এতটুকু। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্রেতা আগমনে সরব হয়ে উঠেছে এলাকাটি।
সামাজিক অবস্থা ও মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তনের কারণে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই শঙ্খশিল্প বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে স্বল্পমূল্যের বিভিন্ন ধরনের চুড়ি ও বালা পাওয়া যায়। এসব চুড়ি ও বালা শাঁখার তুলনায় টেকসই ও মনোহর। বিপণন ব্যবস্থায় উন্নতি হলে শঙ্খশিল্পের বর্তমান দৈন্যদশা কেটে যাবে বলে অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে অতীতের মতো বর্তমানেও শঙ্খের তৈরি পণ্যসামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ লাভ করতে পারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
প্রতিক্ষন/এডমি/এফজে